Class Nine Or Ten : বাংলাদেশ ও বিশ্ব

1. র্পূব বাংলার আন্দোলন জাতীয়তাবাদের উত্থান (১৯৪৭-১৯৭০) |


বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে ভাষা আন্দোলন

পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই এই রাষ্ট্রের ভাষা কী হবে তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ১৯৩৭ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগের দাপ্তরিক ভাষা উর্দু করার প্রস্তাব করলে বাঙ্গালিদের নেতা শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক এর বিরোধিতা করেন। ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়, তখনই বিতর্কটি পুনরায় শুরু হয়। ১৯৪৭ সালের ১৭ মে তারিখ চৌধুরী খলীকুজ্জামান এবং জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড.জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন। তাদের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার ভাষা বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং ড.মুহাম্মদ এনামুল হকসহ বেশ ক'জন বুদ্ধিজীবী এ প্রসঙ্গে প্রবন্ধ লিখে প্রতিবাদ জানান। ১৯৪৭ সালে কামরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত গণ আজাদী লীগ মাতৃভাষায় 'শিক্ষা দান' এর দাবি জানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে ২ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিশ নামক একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ৬-৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত উক্ত সংগঠনের যুবকর্মী সম্মেলনে 'বাংলাকে শিক্ষা ও আইন আদালতের বাহন' করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর এ সংগঠন 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু' নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। এ সময়ে তমদ্দুন মজলিশ 'ভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করে.১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচীতে অনুষ্ঠিত এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।  ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের ভাষা হিসেবে ইংরেজি এবং উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের দাবি জানান। তার দাবি অগ্রাহ্য হলে ২৬ ও ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ' পুনর্গঠিত হয়। ১১ মার্চ 'বাংলা ভাষা দাবি দিবস' পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ঐ দিন সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৫ মার্চ সংগ্রাম পরিষদের সাথে ৮ দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।

১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত সভায় দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।  ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনেও তিনি অনুরূপ ঘোষণা দিলে ছাত্র সমাজ প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে এবং 'না,না' বলে তার উক্তির প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তান সরকার আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের উদ্যোগ নিলে প্রতিবাদ আরো তীব্র হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই পূর্ব বাংলায় ভাষাকেন্দ্রিক যে আন্দোলন শুরু হয় তা ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি আস্থার বহিঃপ্রকাশ।

১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন জিন্নাহকে অনুসরণ করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার নতুন ঘোষণা দেন। এর প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ধর্মঘট পালন করে। আবদুল মতিনকে আহবায়ক করে নতুন সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়।

ভাষার দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি সরকারি এক ঘোষণায় ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪৪ ধারা জারিসহ সভা সমাবেশ, মিছিল এক মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হ্য়। ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, ১০ জন করে মিছিল শুরু করা হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল এগিয়ে চলে। পুলিশ প্রথমে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে, মিছিলে লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি বর্ষণ করলে আবুল বরকত, জব্বার,রফিক, সালামসহ অনেকে শহিদ হন.২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশাল শোক র‍্যালি বের হয়। এখানেও পুলিশের হামলায় শফিউর নামে একজনের মৃত্যু হয়।

শহিদদের স্মৃতি অমর করে রাখার জন্য ঢাকায় ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্র জনতা মেডিকেল কলেজের সামনে একটি শহিদ মিনার স্থাপন করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি শফিউরের পিতাকে দিয়ে প্রথম শহিদ মিনার উদ্বোধন করা হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ উক্ত শহিদ মিনার ভেঙ্গে ফেলে। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী 'কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি' শীর্ষক প্রথম কবিতা এবং তরুণ কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ 'স্মৃতির মিনার' কবিতাটি রচনা করেন। এ সব হত্যাকাণ্ড পূর্ব বাংলার জনগণের মনের উপর বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। আবদুল গাফফার চৌধুরী ড়োচোণা করেন, 'আমার ভায়ের রক্তে রাঙ্গানো ২১ শে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি', সঙ্গীতশিল্পী আবদুল লতিফ রচনা ও সুর করেন,'ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়', এছাড়া 'তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি'র মত সঙ্গীত। ড.মুনীর চৌধূরী জেলে বসে রচনা করেন 'কবর' নাটক, জহির রায়হান রচনা করেন 'আরেক ফাল্গুন' উপন্যাসটি।  ১৯৪৭ সালে সূচিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সালে প্রতিবাদ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে রূপ লাভ করে। ফলে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা ভাশাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে পূর্ব বাংলার বাঙালি এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠী মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস ও আত্মপ্রত্য্য খুঁজে পায়।

More Details...

পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই এই রাষ্ট্রের ভাষা কী হবে তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ১৯৩৭ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগের দাপ্তরিক ভাষা উর্দু করার প্রস্তাব করলে বাঙ্গালিদের নেতা শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক এর বিরোধিতা করেন। ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়, তখনই বিতর্কটি পুনরায় শুরু হয়। ১৯৪৭ সালের ১৭ মে তারিখ চৌধুরী খলীকুজ্জামান এবং জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড.জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন। তাদের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার ভাষা বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং ড.মুহাম্মদ এনামুল হকসহ বেশ ক'জন বুদ্ধিজীবী এ প্রসঙ্গে প্রবন্ধ লিখে প্রতিবাদ জানান। ১৯৪৭ সালে কামরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত গণ আজাদী লীগ মাতৃভাষায় 'শিক্ষা দান' এর দাবি জানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে ২ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিশ নামক একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ৬-৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত উক্ত সংগঠনের যুবকর্মী সম্মেলনে 'বাংলাকে শিক্ষা ও আইন আদালতের বাহন' করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর এ সংগঠন 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু' নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। এ সময়ে তমদ্দুন মজলিশ 'ভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করে.১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচীতে অনুষ্ঠিত এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।  ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের ভাষা হিসেবে ইংরেজি এবং উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের দাবি জানান। তার দাবি অগ্রাহ্য হলে ২৬ ও ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ' পুনর্গঠিত হয়। ১১ মার্চ 'বাংলা ভাষা দাবি দিবস' পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ঐ দিন সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৫ মার্চ সংগ্রাম পরিষদের সাথে ৮ দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।

১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত সভায় দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।  ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনেও তিনি অনুরূপ ঘোষণা দিলে ছাত্র সমাজ প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে এবং 'না,না' বলে তার উক্তির প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তান সরকার আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের উদ্যোগ নিলে প্রতিবাদ আরো তীব্র হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই পূর্ব বাংলায় ভাষাকেন্দ্রিক যে আন্দোলন শুরু হয় তা ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি আস্থার বহিঃপ্রকাশ।

১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন জিন্নাহকে অনুসরণ করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার নতুন ঘোষণা দেন। এর প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ধর্মঘট পালন করে। আবদুল মতিনকে আহবায়ক করে নতুন সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়।

ভাষার দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি সরকারি এক ঘোষণায় ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪৪ ধারা জারিসহ সভা সমাবেশ, মিছিল এক মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হ্য়। ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, ১০ জন করে মিছিল শুরু করা হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল এগিয়ে চলে। পুলিশ প্রথমে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে, মিছিলে লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি বর্ষণ করলে আবুল বরকত, জব্বার,রফিক, সালামসহ অনেকে শহিদ হন.২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশাল শোক র‍্যালি বের হয়। এখানেও পুলিশের হামলায় শফিউর নামে একজনের মৃত্যু হয়।

শহিদদের স্মৃতি অমর করে রাখার জন্য ঢাকায় ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্র জনতা মেডিকেল কলেজের সামনে একটি শহিদ মিনার স্থাপন করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি শফিউরের পিতাকে দিয়ে প্রথম শহিদ মিনার উদ্বোধন করা হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ উক্ত শহিদ মিনার ভেঙ্গে ফেলে। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী 'কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি' শীর্ষক প্রথম কবিতা এবং তরুণ কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ 'স্মৃতির মিনার' কবিতাটি রচনা করেন। এ সব হত্যাকাণ্ড পূর্ব বাংলার জনগণের মনের উপর বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। আবদুল গাফফার চৌধুরী ড়োচোণা করেন, 'আমার ভায়ের রক্তে রাঙ্গানো ২১ শে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি', সঙ্গীতশিল্পী আবদুল লতিফ রচনা ও সুর করেন,'ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়', এছাড়া 'তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি'র মত সঙ্গীত। ড.মুনীর চৌধূরী জেলে বসে রচনা করেন 'কবর' নাটক, জহির রায়হান রচনা করেন 'আরেক ফাল্গুন' উপন্যাসটি।  ১৯৪৭ সালে সূচিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সালে প্রতিবাদ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে রূপ লাভ করে। ফলে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা ভাশাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে পূর্ব বাংলার বাঙালি এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠী মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস ও আত্মপ্রত্য্য খুঁজে পায়।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে রাজনৈতিক আন্দোলনের ভূমিকা

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজনৈতিক চরিত্র এবং একই সঙ্গে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভুলগুলো বুঝতে পারে। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ বাঙ্গালি হওয়ার পরও রাষ্ট্র পরিচালনা, প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগসহ সর্বক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কর্তৃত্ব শুরু করে। বাঙ্গালি তথা পূর্ব বাংলার মানুষ মানুষ সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত হতে থাকে। তখন রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের মধ্যে তিনটি ধারা লক্ষ করা যায়। এগুলো হচ্ছে ১। পাকিস্তানের প্রতি অনুগত রাজনৈতিক দল যেমন, মুসলিম লীগ ও ইসলাম নামধারী দলসমূহ জামাতে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম। ২। পূর্ব বাংলার স্বার্থ রক্ষার জন্য সোচ্চার রাজনৈতিক দল। যেমন, আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, ৩। সাম্যবাদী আদর্শের রাজনৈতিক ধারা।

More Details...

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজনৈতিক চরিত্র এবং একই সঙ্গে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভুলগুলো বুঝতে পারে। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ বাঙ্গালি হওয়ার পরও রাষ্ট্র পরিচালনা, প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগসহ সর্বক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কর্তৃত্ব শুরু করে। বাঙ্গালি তথা পূর্ব বাংলার মানুষ মানুষ সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত হতে থাকে। তখন রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের মধ্যে তিনটি ধারা লক্ষ করা যায়। এগুলো হচ্ছে ১। পাকিস্তানের প্রতি অনুগত রাজনৈতিক দল যেমন, মুসলিম লীগ ও ইসলাম নামধারী দলসমূহ জামাতে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম। ২। পূর্ব বাংলার স্বার্থ রক্ষার জন্য সোচ্চার রাজনৈতিক দল। যেমন, আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, ৩। সাম্যবাদী আদর্শের রাজনৈতিক ধারা।

সামরিক শাসন ও পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ

পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে নস্যাৎ করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক সামরিক-বেসামরিক শাসক গোষ্ঠী তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকে। ফলে সংসদ ও সরকার কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। কেন্দ্রে এবং প্রদেশে ঘন ঘন সরকারের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী ক্ষমতা দখলের সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের পরস্পর বিরোধী এমএলএদের মধ্যে মারামারির মতো এক অপ্রীতিকর ঘটনায় ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী গুরুতর আহত হয়ে পরবর্তীকালে হাসপাতালে মারা যান। এরই সুযোগ নিয়ে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা সামরিক আইন জারি করেন। তিনি দায়িত্ব নিয়ে যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা হচ্ছেঃ ১। ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল, ২। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ ভেঙ্গে দেওয়া, ৩। রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা, ৪। শেখ মুজিবসহ বেশ ক'জন নেতাকে জেলে প্রেরণ ও ৫। সকল মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া।

More Details...

পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে নস্যাৎ করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক সামরিক-বেসামরিক শাসক গোষ্ঠী তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকে। ফলে সংসদ ও সরকার কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। কেন্দ্রে এবং প্রদেশে ঘন ঘন সরকারের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী ক্ষমতা দখলের সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের পরস্পর বিরোধী এমএলএদের মধ্যে মারামারির মতো এক অপ্রীতিকর ঘটনায় ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী গুরুতর আহত হয়ে পরবর্তীকালে হাসপাতালে মারা যান। এরই সুযোগ নিয়ে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা সামরিক আইন জারি করেন। তিনি দায়িত্ব নিয়ে যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা হচ্ছেঃ ১। ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল, ২। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ ভেঙ্গে দেওয়া, ৩। রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা, ৪। শেখ মুজিবসহ বেশ ক'জন নেতাকে জেলে প্রেরণ ও ৫। সকল মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া।

ছয় দফার গুরুত্ব

৬ দফা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিকসহ সকল অধিকারের কথা তুলে ধরে। আইয়ুব সরকার একে 'বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মসূচি' উল্লেখ করে। এ কর্মসূচি বাঙ্গালি জাতির চেতনা-মূলে বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতার কথা না বললেও বাঙালিদের স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তাই এটি ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। পাকিস্তান সরকার এটি গ্রহণ না করে দমন পীড়া শুরু করলে আন্দোলন অনিবার্য হয়ে উঠে।

প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য

পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীতে বাঙ্গালিদের নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য বিরাজ করত। মোট অফিসারের মাত্র ৫%, সাধারণ সৈনিকদের মাত্র ৪%, নৌবাহিনীর উচ্চ পদে ১৯%, নিম্নপদে ৯%, বিমান বাহিনীর পাইলটের ১১% ও টেকনিশিয়ানদের ১.৭% ছিলেন বাঙ্গালি।

অর্থনৈতিক বৈষম্য

পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির কারণে পূর্ব বাংলার চাইতে পশ্চিম পাকিস্তান অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। যেমন, ১৯৫৫-১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৫৯-৬০ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান লাভ করেছিল মোট বাজেট বরাদ্দের ১১৩ কোটি ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা, অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তান তখন পেয়েছিল ৫০০ কোটি টাকা। একইভাবে ১৯৬০ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এ অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বেড়ে যায়। একইভাবে ১৯৬০-৬১ থেকে ১৯৬৪-৬৫ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল ৬৪৮০ মিলিয়ন টাকা, আর পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা ছিল ২২,২৩০ মিলিয়ন টাকা।ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন, কৃষিসহ অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তান কয়েকগুণ পিছিয়ে পড়ে।

যুক্তফ্রন্ট গঠন, নির্বাচন ও সরকার

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শাসক দল মুসলিম লীগ দীর্ঘদিন নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার গঠনের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এছাড়া প্রাদেশিক সরকার নিয়ে কেন্দীয় সরকারের টালবাহানা পূর্ব বাংলার জনগনের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে। পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম মীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটানোর লক্ষ্যে ১৯৫৩ সালের ১৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২১ দফা প্রণয়ন শেষে ৪ টি দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়।দল ৪ টি হলঃ আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম এবং গণতন্ত্রী দল। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে জনগণ যুক্তফ্রন্টের ২১ দফাকে তাদের স্বার্থ রক্ষার সনদ বিবেচনা করে।

শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

১৯৫৩ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারী শহিদ দিবস হিসাবে দেশব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারী শহিদ মিনারে নগ্ন পায়ে হেঁটে ফুল অর্পণ করে আমরা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। বাঙ্গালি জাতির কাছে এটি একটি শোকের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার দিন। কানাডা প্রবাসী কয়েকজন বাঙ্গালির উদ্যোগ ও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সরকারের কুটনৈতিক তৎপরতার ফলে ১৯৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী জাতিসংঘের শিক্ষা,বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো  ২১ ফেব্রুয়ারী্র শহিদ দিবসকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। পৃথিবীতে ৬০০০ এর বেশি ভাষা রয়েছে। এ সব ভাষার মানুষ সেই থেকে বাংলাদেশের শহিদ দিবসের গুরুত্ব উপলব্ধি করে নিজেদের ভাষার মর্ম নতুনভাবে বুঝতে শিখেছে। আমাদের দেশেও বাংলা ভাষার পাশাপাশি বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর ভাষা রয়েছে। আমরা ঐসব ভাষা ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং উন্নয়নে সচেষ্ট হব।

সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন

আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৬১ সালেই পূর্ব বাংলায় আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬২ সালের জানুয়ারী মাসে বাঙ্গালিদের প্রিয় নেতা ও পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করা হলে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হলে রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। ১৯৬২ সালে আইয়ুবের প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠে। ঐ সময় ছাত্র সমাজ ১৫ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করে। শিক্ষানীতি বিষয়ক আন্দোলনে বিভিন্ন পেশাজীবীরাও অংশগ্রহণ করে। এই সঙ্গে সাংবিধানিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) গঠিত হয়। এই সংগঠন আইয়ুব খানের শাসন বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলে। ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উপলক্ষে রাজনৈতিক দলগুলো সামরিক শাসন বিরোধী বক্তব্য নিয়ে জনগণের কাছে যাওয়ার সুযোগ পায়।

৬ দফা

পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি পাকিস্তান রাষ্ট্রের চরম বৈষম্যমূলক আচরণ ও অবহেলার বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে ৬ দফার স্বায়ত্তশাসনের দাবিনামায়। ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলসমূহের এক সম্মেলনে যোগদান করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করে পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার রক্ষার জন্য ৬ দফা তুলে ধরেন। দফাগুলো হচ্ছে-

১)যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাধীনে সংসদীয় পদ্ধতিতে সরকার হবে। সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটে নির্বাচন অনুষ্ঠান।

২)কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে মাত্র দুটি থাকবে; প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়।অন্যান্য সকল বিষয়ে অঙ্গরাজ্যগুলোর পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে।

৩)সারাদেশে হয় অবাধে বিনিময়যোগ্য দুধরনের মুদ্রা,না হয় বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে একই ধরনের মুদ্রা করা যাবে।

৪)সকল প্রকার কর ধার্‍য্য করার ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। আঞ্চলিক সরকারের আদায়কৃত রাজস্বের একটি নির্দিষ্ট অংশ কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে।  

৫)অঙ্গরাজ্যগুলো নিজেদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার মালিক হবে, এর নির্ধারিত অংশ তারা কেন্দ্রে দিবে।

৬)অঙ্গরাজ্যগুলোকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য আধা সামরিক বাহিনী করার ক্ষমতা দেওয়া।

যুক্তফ্রন্ট সরকার

১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল যুক্তফ্রন্টভুক্ত কৃষক শ্রমিক-পার্টির নেতা এ কে ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। যুক্তফ্রন্ট সরকার মাত্র ৫৬ দিন ক্ষমতায় ছিল। পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলার যুক্তফ্রন্ট সরকারকে মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি। তারা ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নেয়। আদমজি পাটকল ও কর্ণফুলী কাগজের কলে বাঙ্গালি-অবাঙ্গালি দাঙ্গাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ১৯৫৪ সালের ৩০ মে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করে। উল্লেখ্য পাকিস্তান সরকারের ইন্ধনে ঐ দাঙ্গা হয়েছিল। শেরে বাংলাকে গৃহবন্দী করা হয়, শেখ মুজিবসহ তিন হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। এর মাধ্যমে পূর্ব বাংলার প্রতি পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর চরম বৈরী মনোভাব প্রকাশ পায়। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের অরাজক শাসনের পর্ব শুরু হয়। কেন্দ্র এবং প্রদেশে ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন হতে থাকে। অবশেষে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করে সংকট ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। গণতন্ত্র থেকে বিচ্যুত হয়ে সামরিক শাসন জারি করে পাকিস্তান রক্ষার শেষ চেষ্টা করা হয়।

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান

পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণের স্বতঃসফূর্ত অংশগ্রহণে ১৯৬৯ সালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন সংঘটিত হয়। ইতিহাসে এটি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নামে পরিচিত। এটি বিপ্লবাত্মক রূপ সংগ্রহ করে। সকল গণতান্ত্রিক দল, পেশাজীবী সংগঠন ও মানুষ যার যার অবস্থান থেকে এ আন্দোলনে যুক্ত হয়। এ আন্দোলনে যুক্ত হতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামান আসাদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা শহিদ হন। প্রদেশব্যাপী ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক সহ সকল শ্রেনীপেশার মানুষ রাস্তায় নামে। সর্ব স্তরের মানুষের আন্দোলনের ফলে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান শেখ মুজিবুর রহমান কে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হন। অন্য নেতৃবৃন্দকেও মুক্তি দেওয়া হয়।  আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানে তাঁকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করা হয়। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ফলে সামরিক শাসক আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

২১ দফা

১।বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হবে।

২।বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ, সকল প্রকার মধ্যস্বত্ব ও সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল করা  হবে।

৩। পাট ব্যবসাকে বাণিজ্যকরণ, পাটের ন্যায্যমূল্য প্রদান এবং পাট কেলেঙ্কারির সাথে জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থা।

৪। সমবায় কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন,কুটির ও হস্তশিল্পের উন্নতি সাধন

৫।পূর্ব বাংলার লবণ শিল্পের সম্প্রসারণ ও লবণ কেলেঙ্কারির সাথে জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থা

৬। বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন

৭। সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বন্যানিয়ন্ত্রণ ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের ব্যবস্থা।

৮। পূর্ব বাংলাকে শিল্পায়িত ও শ্রনিকদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার রক্ষা

৯। অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন,শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা

১০। বাংলাকে শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দান

১১। ঢাকা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও কালাকানুন বাতিল

১২। প্রশাসনিক ব্যয় সংকোচন, উচ্চ ও নিম্নবেতনভুক্ত কর্মচারীদের মধ্যে বেতন বৈষম্য হ্রাস

১৩। সকল প্রকার দুর্নীতি নির্মূল

১৪। রাজবন্দিদের মুক্তিদান, বাকস্বাধীনতা, সভাসমিতি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত

১৫। শাসন বিভাগ হতে বিচার বিভাগ পৃথক করা

১৬। বর্ধমান হাউসকে ছাত্রাবাস ও বাংলা ভাষা সাহিত্যের গবেষণাগার করা

১৭। বাংলা ভাষা শহিদদের স্মরণে শহিদ মিনার নির্মাণ

১৮। একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস ও সরকারি ছুটি ঘোষণা

১৯। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান

২০। নিয়মিত ও অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা

২১। পরপর তিনটি উপনির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট পরাজিত হলে মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবে।

আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল

১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান ইস্কান্দার মীর্জাকে উৎখাত ও দেশত্যাগে বাধ্য করে ক্ষুমতা দখল এবং নিজেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত করেন। সামরিক শাসন দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে তিনি মৌলিক গণতন্ত্র নামে একটি ব্যবস্থা চালু করেন। এই ব্যবস্থায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মোট ৮০ হাজার  নির্বাচিত ইউ্নিয়ন কাউন্সিল সদস্য নিয়ে নির্বাচকমন্ডলী গঠন হবে। তাদের ভোটেই রাষ্ট্রপতি, জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার বিধান রাখা হয়। এটি ছিল পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি। ১৯৬৫ সাল ৮০ হাজার মেম্বারের ভোটে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সামরিক শাসনের ফলে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের হাতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সকল ক্ষেত্রে বৈষম্য চরম আকারে ধারণ করতে থাকে।

1970

১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দেন।ইয়াহিয়া খান উক্ত পদে আসীন হন।তিনি ২৮ মার্চ এক ঘোষণায় পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দেন। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর 'এক ব্যক্তির এক ভোটের ভিত্তিতে' নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, মুসলিম লীগ, পাকিস্তান পিপলস পার্টি, ডেমোক্রেটিক পার্টি, জামাত-ই-ইসলামি প্রভৃতি দল অংশগ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে ৬ দফার পক্ষে গণভোট হিসেবে অভিহিত করে। নির্বাচনে ৫ কোটি  ৬৪ লাখ ভোটারের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ছিল ৩ কোটি ২২ লাখ। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের নির্ধারিত ১৬৯ টি আসনের ১৬৭ টি আসন লাভ করে। ১৭ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে ৩০০ টির মধ্যে ২৮৮ টি আসন আওয়ামী লীগ লাভ করে।

যুদ্ধ

১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধ ১৭ দিন অব্যাহত ছিল। তখন পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণরূপে অরক্ষিত ছিল। বিষয়টি পূর্ব পাকিস্তানের কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং বৈষম্যমূলক মনে হয়েছিল। এ সময় 'ইসলাম বিপন্ন হওয়া' রবীন্দ্র সঙ্গীতকে 'হিন্দু সংস্কৃতি', নজরুল ইসলামের গানে 'হিন্দুয়ানি'র অভিযোগ তুলে এসবের চর্চা বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়।

১৫ দফা

আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৬১ সালেই পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬২ সালের জানুয়ারি মাসে বাঙালিদের প্রিয় নেতা ও পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করা হলে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসে শেখ মুজিবকে প্রেপ্তার করা হলে আন্দোলন রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে আরো বেগবান হয়। ১৯৬২ সালে আইয়ুবের প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। ঐ সময় ছাত্র সমাজ ১৫ দফা দাবি কর্মসূচি ঘোষণা করে।

আওয়ামী লীগ

মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতাত্ত্বিক ধ্যান ধারণা থেকে বের হয়ে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল বাঙ্গালি রাজনৈতিক নেতৃত্ব ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজগার্ডেনে এক সম্মেলনের মাধ্যমে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' গঠন করে। সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক এবং যুগ্ম সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদ। শুরুতেই দলটি বাঙালিদের স্বার্থে একটি বিস্তৃত কর্মসুচি গ্রহণ করে। এর মধ্যে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, জনগণের সার্বভৌমত্ব, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান, পাট ও চা শিল্প জাতীয়করণ, বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদ, কৃষকদের মধ্যে জমি বণ্টন, সমবায় ভিত্তিক চাষাবাদ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ দলটি পাকিস্তানের সরকারের রোষানলে পড়ে। শেখ মুজিব ১৯৪৯ সালে কারাগারে প্রেরিত হন। ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্দী জীবন কাটান। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠনের মূল উদ্যোগ ছিল আওয়ামী লীগের। ১৯৫৫ সালে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করে দলের নাম 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ' নামকরণ করা হয়। ফলে ধর্ম পরিচয় নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।

GO TOP